পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিক দূষণ রোধে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার
কৃষিবিদ ড. মোঃ আল-মামুন
বিজ্ঞানের অন্যান্য আবিষ্কারের মতো প্লাস্টিকের আবিষ্কারও ছিল চমকপ্রদ ও কল্যাণকর। তবে প্লাস্টিক বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা আজ মানবসভ্যতাকে ফেলেছে এক ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে। প্লাস্টিক ও ন্যানো প্লাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ জীবের শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন এবং ক্যান্সারসহ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হতে পারে।
প্লাস্টিক হচ্ছে কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি যেকোনো দ্রব্যের চেয়ে সস্তা, ব্যবহারবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী। ফলে বিদ্যুৎগতিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে এবং অবচেতন মনেই আমরা জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের সবকিছুকে প্লাস্টিক দূষণে দূষিত করে ফেলছি। বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী ২০৩১ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হবে। পরিবেশে অপচনশীল নানা রকম প্লাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মি এবং পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা এবং নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বিসফেনল-এ, ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস এবং ব্রোমিনেটেড ফেইম রিটারডেন্টস পরিবেশে নির্গত হয়। এসব প্লাস্টিক ন্যানো কণা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের কোষাভ্যন্তরে অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে পরিবর্তন করে ক্যান্সার বা স্নায়ুতন্ত্র বিকল এবং প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে।
প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। পৃথিবীজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ আমরা ব্যবহারের পর ফেলে দিচ্ছি। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর মোট খনিজ তেলের ৪% ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ জৈববিয়োজনশীল নয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পুরালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড মেশে। প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ। এর ফলে প্রতিবছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের শরীরে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, প্রতিদিন ৮০ লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। এভাবে জমতে জমতে বড় বড় মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা (প্যাচ) তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশান্ত মহাসাগরে বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্যাচের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। অনুরূপ প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা অন্যান্য মহাসাগর এবং সাগরেও সৃষ্টি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, সমুদ্রের পানির উপরিস্তরের প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ কমবেশি প্লাস্টিক দূষণে দূষিত।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের জন্য দুটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশে পচনরোধী প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য, উপজাত, কণিকা বা প্লাস্টিকের দ্রব্য নিঃসরিত অণুর সংযোজন; যা মাটি, পানি, বায়ুম-ল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত বিশ্বেও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত তৈরি হয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পৃথিবীর সর্বাধিক প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারকারী দেশ ইতালি। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দেশের মধ্যে আছে ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রাজ্য। এ তালিকা প্রতি বছরই বাড়ছে। ওয়ালমার্ট, টেসকোর মতো বৃহৎ চেইন শপগুলো পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব জানার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের বিকল্প সন্ধান করা হচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্রাকৃতিক পলিমারের মাধ্যমে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য সচেতনভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে বাণিজ্যিক পূর্ণচক্রায়ণ, প্লাস্টিকের বিকল্প পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার, একক ব্যবহার পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে কাপড়ের, কাগজের কিংবা বহুবার ব্যবহারযোগ্য ব্যাগের ব্যবহার এবং প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে সচেতন নাগরিক তৈরি কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের উষ্ণায়নের ১০-১৩ শতাংশ অবদান হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর মাধ্যমে। এসব ক্ষতিকারক বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কজাত করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাটের সুতা মূলত সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ ও লিগনিন দ্বারা গঠিত। সেজন্য পাটজাত দ্রব্যের বর্জ্য সহজে পরিবেশে পচে মৃত্তিকার উর্বরা শক্তি বাড়ায়। পাট ও পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পাটপণ্যকে ‘বর্ষপণ্য ২০২৩’ ঘোষণা করেছে সরকার। বাংলাদেশের সোনালি আঁশের মাধ্যমে তৈরি সোনালি ব্যাগসহ প্লাস্টিকের বিকল্প অন্যান্য পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। সর্বত্র পাটজাত পণ্যের প্রাপ্তি সুলভ করতে সরকার এসব পণ্য উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করে উৎপাদনকারীদের উৎসাহী করে তুলতে পারে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৭১১১৮৬০৫১, ই-মেইল : almamunbjri@gmail.com